মুহাম্মদ কামাল খান | ১৪ মার্চ ২০১৭
অসমাপ্ত আত্মজীবনী বইটিতে লেখকের বংশ পরিচয়, জন্ম, শৈশব, স্কুল ও কলেজের শিক্ষা জীবনের পাশাপাশি সামাজিক ও রাজনৈতিক কর্মকাণ্ড, দুর্ভিক্ষ, বিহার ও কলকাতার দাঙ্গা, দেশভাগ, কলকাতা কেন্দ্রিক প্রাদেশিক মুসলিম ছাত্রলীগ ও মুসলিম লীগের রাজনীতি, দেশ বিভাগের পরবর্তী সময় থেকে ১৯৫৪ সাল অবধি পূর্ববাংলার রাজনীতি, কেন্দ্রীয় ও প্রাদেশিক মুসলিম লীগ সরকারের অপশাসন, ভাষা আন্দোলন, ছাত্রলীগ ও আওয়ামী লীগ প্রতিষ্ঠা, যুক্তফ্রন্ট গঠন ও নির্বাচনে বিজয়ী হয়ে সরকার গঠন, আদমজীর দাঙ্গা, পাকিস্তান কেন্দ্রীয় সরকারের বৈষম্যমূলক শাসন ও প্রাসাদ ষড়যন্ত্রের বিস্তৃত বিবরণ এবং এসব বিষয়ে লেখকের প্রত্যক্ষ অভিজ্ঞতার বর্ণনা রয়েছে। আছে লেখকের কারাজীবন, পিতা-মাতা, সন্তান-সন্তুতি ও সর্বোপরি সর্বংসহা সহধর্মিণীর কথা, যিনি তার রাজনৈতিক জীবনে সহায়ক শক্তি হিসেবে সকল দুঃসময়ে অবিচল পাশে ছিলেন। একই সঙ্গে লেখকের চীন, ভারত ও পশ্চিম পাকিস্তান ভ্রমণের বর্ণনাও বইটিকে বিশেষ মাত্রা দিয়েছে। বঙ্গবন্ধুর অসমাপ্ত আÍজীবনী কেবল ইতিহাসের অনাবিষ্কৃত সত্য উন্মোচনই নয়, এই জীবনী গ্রন্থ পাঠে আমরা তরুণ শেখ মুজিবুর রহমানের সাহস, আত্মত্যাগ, দূরদৃষ্টি, অতুলনীয় সাংগঠনিক নৈপুণ্য, রাজনৈতিক প্রজ্ঞা এবং জাতীয় নেতায় উত্তরণের পর্যায়ক্রমগুলোকে আবিষ্কার করে অভিভূত হই। আমরা বিমুগ্ধ বিস্ময়ে আবিষ্কার করি দেশ ও জাতির জন্য অন্ধ একজন বেহিসেবি প্রেমিক, রোমান্টিক দ্রোহী, আদর্শ স্বামী, স্মেহশীল পিতা এবং প্রবুদ্ধ মহামানবকে। বর্তমানে রাজনীতিতে আত্মত্যাগ, আদর্শবাদ, সততা ও নিষ্ঠার এই আকালের দিনে বঙ্গবন্ধুর অসমাপ্ত আত্মজীবনী গ্রন্থটি হতে পারে নতুন আলোকবর্তিকা।
বই লেখা সম্পর্কে বঙ্গবন্ধু লিখেছেন, বন্ধুবান্ধবরা বলে, ‘তোমার জীবনী লেখ’। সহকর্মীরা বলে, ‘রাজনৈতিক জীবনের ঘটনাগুলো লিখে রাখ, ভবিষ্যতে কাজে লাগবে’। আমার সহধর্মিণী একদিন জেলগেটে বসে বলল, ‘বসেই তো আছ, লেখ তোমার জীবনের কাহিনী’। বললাম, ‘লিখতে যে পারি না; আর এমনকি করেছি, যা লেখা যায়! আমার জীবনের ঘটনাগুলো জেনে জনসাধারণের কি কোনো কাজে লাগবে? কিছুই তো করতে পারলাম না। শুধু এইটুকু বলতে পারি, নীতি ও আদর্শের জন্য সামান্য একটু ত্যাগ স্বীকার করতে চেষ্টা করেছি।’ একদিন সন্ধ্যায় বাইরে থেকে তালা বন্ধ করে দিয়ে জমাদার সাহেব চলে গেলেন। ঢাকা কেন্দ্রীয় কারাগারের ছোট্ট কোঠায় বসে জানালা দিয়ে আকাশের দিকে চেয়ে কেমন করে তার সান্নিধ্য আমি পেয়েছিলাম। কীভাবে তিনি আমাকে কাজ করতে শিখিয়েছিলেন এবং কেমন করে তার স্নেহ আমি পেয়েছিলাম। হঠাৎ মনে হলো লিখতে ভালো না পারলেও ঘটনা যতদূর মনে আছে লিখে রাখতে আপত্তি কি? সময় তো কিছু কাটবে। বই ও কাগজ পড়তে পড়তে মাঝে মাঝে চোখ দুটিও ব্যথা হয়ে যায়। তাই খাতাটা নিয়ে লেখা শুরু করলাম। আমার অনেক কিছুই মনে আছে। স্মরণশক্তিও কিছুটা আছে। নিজের জেলজীবন সম্পর্কে বইয়ের একাংশে বঙ্গবন্ধু লিখেছেন, ‘আমি যখন ঢাকা জেলে এলাম তখন ১৯৫১ সালের শেষের দিক হবে। প্রায় এক মাস জেল হাসপাতালে রইলাম। আমার মালপত্র সেই পুরনো জায়গায় নিয়ে রাখা হয়েছিল। মওলানা ভাসানী সাহেব আগেই মুক্তি পেয়ে গেছেন। কয়েক দিন পর খবর পেলাম, বরিশালের মহিউদ্দিন সাহেবকে ঢাকা জেলে নিয়ে আসা হয়েছে, নিরাপত্তা আইনে বন্দী করে। সে কিছু দিন আগ পর্যন্ত জেলা মুসলিম লীগের সম্পাদক ছিল। সাম্প্রদায়িক দাঙ্গায় জড়িত থাকার জন্য তাকে নাকি সরকার গ্রেফতার করেছে। ১৯৫১ সালে বরিশালে এক ভয়াবহ দাঙ্গা হয়েছিল। মহিউদ্দিন পাকিস্তান আন্দোলনের ভালো কর্মী ছিল। ছাত্র আন্দোলনে সে আমার বিরুদ্ধ দলে ছিল। আমরা মুসলিম লীগ ত্যাগ করলেও সে ত্যাগ করেনি। বরিশালে তারই এক সহকর্মী আমার বিশিষ্ট বন্ধু কাজী বাহাউদ্দিন জেলা ছাত্রলীগের নেতা ছিলেন এবং মহিউদ্দিন সাহেবের বিরুদ্ধ দলে ছিলেন। আমি ও আমার সহকর্মীরা মহিউদ্দিনকে ভালো চোখে দেখতাম না। কারণ, তখন পর্যন্ত সে সরকারের অন্ধ সমর্থক ছিল। মহিউদ্দিনের সঙ্গে আলাপ করে দেখলাম, তার অনেক পরিবর্তন হয়েছে। বের হতে পারলে সে আর মুসলিম লীগ করবে না, সেটা আমি বুঝতে পারলাম। সাম্প্রদায়িক রাজনীতি যে পাকিস্তানের জন্য ক্ষতিকর এ কথাও সে স্বীকার করল।
ঢাকা জেল হাসপাতালে আমার চিকিৎসা হবে না, ঢাকা মেডিকেল কলেজ হাসপাতালে পাঠাতে হবে। আমি জানিয়ে দিলাম আমাকে কেবিন দিতে হবে, না হলে আমি যাব না। সরকার কেবিন দিতে রাজি হলো। আমাকে মেডিকেল কলেজে নিয়ে যাওয়ার বন্দোবস্ত চলছে। আমার ও মহিউদ্দিনের মধ্যে অনেক ভুল বোঝাবুঝি ছিল আগে, এখন দুজনই বন্দী। আমাদের মধ্যে বন্ধুত্ব গড়ে উঠল। মহিউদ্দিন আমাকে বলল, ‘তোমার জন্য তো তোমার দল ও ছাত্রলীগ মুক্তি-আন্দোলন করবে। আমার জন্য কেউ করবে না, আমি তো মুসলিম লীগে ছিলাম, আর মুসলিম লীগ সরকারই আমাকে গ্রেফতার করেছে। তুমি তো বোঝ, আমি রাজনৈতিক কর্মী। আমার পক্ষে নিজ হাতে দাঙ্গা করা সম্ভব নয়; আমার নামে মিথ্যা কথা রটাচ্ছে। কারণ লীগের মধ্যে দুটো দল হয়ে গেছে। আমি নূরুল আমিন সাহেবের দলের বিরুদ্ধে, তাই তিনি আমাকে নিরাপত্তা আইনে গ্রেফতার করেছেন।’ আরও বলল, ‘তোমার জন্য শহীদ সাহেব ও ভাসানী সাহেবও আন্দোলন করবেন।’ আমি বললাম, ‘যা হবার হয়ে গেছে, তারা আমার মুক্তি চাইলে তোমার মুক্তিও চাইবেন। সে বন্দোবস্তও আমি করব, তুমি দেখে নিও।’বইটি পড়ে আমার মনে হয়েছে, বাংলাদেশের প্রতিটি নাগরিকের এই বইটি পড়া উচিত। বঙ্গবন্ধুর মহাত্ম সম্পর্কে জানতে হলে এই বইটি পড়ার বিকল্প নেই। বঙ্গবন্ধুর আত্মজীবনী গ্রন্থে ইতিহাসের এমন সব অনুদ্ঘাটিত সত্য ঘটনা, ব্যক্তির ভূমিকা, ব্যক্তি চরিত্রের শক্তি-দুর্বলতা-দোলাচল-আপসকামিতা-বিশ্বাসঘাতকতা-আত্মত্যাগ, সততা ও নিষ্ঠার অপ্রকাশিত বিবরণী রয়েছে, যা আমাদের জানা রাজনৈতিক ইতিহাস এবং পরিচিত অনেক রাজনীতিবিদ সম্পর্কে এতদিনের ধারণা, বিশ্বাস ও মূল্যায়নকে প্রবলভাবে উল্টে-পাল্টে দেবে।
লেখক: সভাপতি ম্যানেজিং কমিটি জয়নগর এম ইউ সিনিয়র মাদ্রাসা, কাশিয়ানী, গোপালগঞ্জ।
শনি | রবি | সোম | মঙ্গল | বুধ | বৃহ | শুক্র |
---|---|---|---|---|---|---|
১ | ২ | ৩ | ৪ | ৫ | ৬ | |
৭ | ৮ | ৯ | ১০ | ১১ | ১২ | ১৩ |
১৪ | ১৫ | ১৬ | ১৭ | ১৮ | ১৯ | ২০ |
২১ | ২২ | ২৩ | ২৪ | ২৫ | ২৬ | ২৭ |
২৮ | ২৯ | ৩০ | ৩১ |