কক্সবাজার প্রতিনিধি | ০৪ ডিসেম্বর ২০১৭
প্রাকৃতিক দুর্যোগ মোকাবিলাসহ গভীর সমুদ্রে তৎপর নৌ বাহিনী। ডুবে যাওয়া মাছ ধরার ট্রলার উদ্ধার,পন্যাবাহি জাহাজে আগুন নিয়ন্ত্রণ,নিখোঁজ বিমান উদ্ধার ও সাগর থেকে লাশ উদ্ধারসহ জীবনের ঝুকি নিয়ে সব ধারনের কাছ করে যাচ্ছে নৌ বাহিনীর সদস্যরা। প্রতি বছর জুন, জুলাই ও আগষ্ট মাসে সমুদ্র সাগরের পানি উৎতাল থাকলেও দেশের নিরাপওা দেওয়ার জন্য ৫ থেকে ৭ টি নৌবাহিনীর যুদ্ধজাহাজ টহলে দিয়ে থাকে।
গত ২৮ ও ২৯ নভেম্বর প্রথম বারের মত কক্সবাজারের বঙ্গোপসাগরে শেষ হয়েছে আন্তর্জাতিক সমুদ্র মহড়া ইমসারেক্স-২০১৭। ভারত মহাসাগরীয় অঞ্চলের দেশসমূহের নৌবাহিনীর মধ্যে আঞ্চলিক সম্প্রীতি ও সহযোগিতা জোরদার করতে বাংলাদেশ বঙ্গোপসাগরে এই আন্তর্জাতিক সমুদ্র মহড়ার আয়োজন করা হয়। এ মহড়ায় এর ৩২টি দেশের মধ্যে ২৩টি সদস্য ও ৯টি পর্যবেক্ষক দেশের নৌবাহিনীর যুদ্ধজাহাজ এবং নৌপ্রধান, উর্দ্ধতন নৌ কর্মকর্তা এবং বিভিন্ন দেশের মেরিটাইম বিশেষজ্ঞগণ অংশ গ্রহন করেন। এছাড়াও ৮টি দেশ থেকে মহড়া পযবেক্ষণ করতে আসা অতিথিরা বলেছেন, আয়োজক হিসেবে সমুদ্রে পারস্পারিক সহযোগীতার একটি মাইলফলক স্থাপন করেছে বাংলাদেশ।
এদিকে শান্তিতে সংগ্রামে সমুদ্রে দুর্জয় এই মহিমান্বিত বাণীর ধারক-বাহক নৌবাহিনীকে প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা আরও শক্তিশালী দেখতে চান। ইতোমধ্যে নৌবহরে যুক্ত হয়েছে আরও নতুন তিনটি যুদ্ধজাহাজ। প্রথমবারের মতো এসেছে দুটি অত্যাধুনিক সাবমেরিন। এছাড়া সরকারের নিজস্ব ব্যবস্থাপনায় হাতে নেয়া হয়েছে যুদ্ধজাহাজ নির্মাণ কার্যক্রম। নৌবাহিনীকে আরও আধুনিকায়নের লক্ষ্যে চীনে নতুন দুটি করভেট নির্মাণের কার্যক্রম শুরু হয়েছে।
এজন্য গতবছর (২০১৬) ২০ মার্চ নতুন তিনটি যুদ্ধজাহাজ কমিশনিংয়ের সময় প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা বলেছিলেন,বিশাল সমুদ্র সম্পদ রক্ষা করবে নৌবাহিনী। তার মতে,ভৌগোলিক অবস্থানগত ও কৌশলগত কারণে বাংলাদেশের জলসীমা ও তার সম্পদ রক্ষায় নৌবাহিনীকে গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা রাখতে হবে। উপকূলীয় এলাকার নিরাপত্তা বিধান নৌবাহিনীর একটি অন্যতম কাজ। কারণ আমাদের রয়েছে ৭১০ কি.মি. উপকূল এলাকা, যেখানে প্রায় তিন কোটি মানুষ প্রত্যক্ষ ও পরোক্ষভাবে জীবিকা নির্বাহের জন্য সমুদ্রের উপর নির্ভরশীল। বহির্বিশ্বের সাথে দেশের বাণিজ্যের ৯০ ভাগেরও বেশি সমুদ্রপথেই পরিচালিত হয়ে থাকে। আমাদের জাতীয় অর্থনৈতিক উন্নয়নে সমুদ্র এলাকার উন্নয়ন ও নিরাপত্তা বিধান করা অপরিহার্য।
নৌ বাহিনীর কর্মকর্তারা জানান, সামুদ্রিক সম্পদ রক্ষা ও দুর্যোগ মোকাবেলায় নৌবাহিনীর দায়িত্ব অনেক বেশি। দেশের বিশাল জলসীমার সার্বভৌমত্ব রক্ষার পাশাপাশি সমুদ্রে অবৈধ অনুপ্রবেশ ও চোরাচালান রোধ, গভীর সমুদ্রে উদ্ধার তৎপরতা বৃদ্ধি, মৎস্য ও প্রাকৃতিক সম্পদ সংরক্ষণ, তেল-গ্যাস অনুসন্ধান ব্লকসমূহে অধিকতর নিরাপত্তা নিশ্চিতের পাশাপাশি সার্বিকভাবে দেশের ব্লু ইকোনমির উন্নয়নে এ বাহিনীর সদস্যরা কাজ করছে। ক্রমাগত সম্পদ আহরণের ফলে বিশ্বের স্থলভাগের সম্পদ আজ সীমিত। তাই সারাবিশ্ব এখন নতুন সম্পদের খোঁজে রয়েছে।
নৌ বাহিনী আরো জানান, বিভিন্ন প্রাকৃতিক দুর্যোগে ত্রাণ ও পুনর্বাসন কার্যক্রম পরিচালনা এবং জাতিসংঘ শান্তি রক্ষা মিশনে বাংলাদেশ নৌবাহিনী সাফল্য দেখিয়েছে। নৌবাহিনী এবং বাংলাদেশ সরকারের আন্তরিক প্রচেষ্টায় মিয়ানমার ও ভারতের সাথে দীর্ঘদিন ঝুলে থাকা সমুদ্র সীমা বিরোধ নিষ্পত্তি হয়েছে। বাংলাদেশের জলসীমার পরিধি বিস্তৃতি লাভ করায় নৌসদস্যদের দায়িত্ব আরো বেড়েছে। আগেই বলা হয়েছে, গড়ে উঠেছে ত্রিমাত্রিক নৌবাহিনী। যুক্ত হয়েছে নতুন নতুন জাহাজ, অত্যাধুনিক এয়ার ক্রাফট। এছাড়া নতুন ঘাঁটি ও সংস্থা তৈরি, নতুন নতুন স্থাপনা প্রস্তুতকরণ, নৌসদস্যদের দক্ষতা বৃদ্ধির জন্য নিয়মিত ও বিশেষ প্রশিক্ষণের ব্যবস্থাসহ বাংলাদেশ নৌবাহিনীর কলেবর আরো বৃদ্ধির প্রক্রিয়া চলছে।
২৮ নভেম্বর সমুদ্র মহড়া ইমসারেক্সের প্রথম দিনে ছিলো গভীর সাগরে বণিক জাহাজের অগ্নি নিবাপন এবং উদ্ধার অভিযান। এই অভিযানে অংশ নেয় ৫টি জাহাজ। নেতৃত্বে ছিলো বাংলাদেশী যুদ্ধজাহাজ বিএনএস সমুদ্র অভিযান। এমভি নৌ কল্যাণ, ২৭ নভেম্বর গভীর সাগরে বণিক জাহাজে আগুন ধরার খবর পেলে আইওএনএস বাংলাদেশ নৌ সদর দপ্তরের সহযোগীতা চাইলে এ উদ্ধার অভিযান শুরু হয়। ইমসারেক্স মহড়ার দ্বিতীয় দিনে কক্সবাজার জেলা প্রশাসন, নৌ-সদর দপ্তর এবং আইওএনসের তত্ত্বাবধানে উদ্ধার করা হয় প্রাকৃতিক দুযোগে নিপতিত মাছ ধরার ট্রলারকে। বানৌজা প্রত্যয়ের নেতৃত্বে অংশ নেয় ইরানী যুদ্ধজাহাজ বন্দর আব্বাসসহ ৩টি বিদেশী জাহাজ।
২৯ নভেম্বর সিভিল অ্যাভিয়েশন কর্তৃপক্ষ বঙ্গোপসাগরের উপর দিয়ে উড়ে যাওয়া একটি ফ্লাইটের নিখোঁজ হওয়ার ঘোষণা দেয়। এরপর ভারত মহাসাগরীয় দেশগুলোর সংগঠন আইওএনএস সদস্য অন্যান্য দেশগুলোর মত উড়োজাহাজটি উদ্ধারের জন্য অনুরোধ করে বাংলাদেশ নৌবাহিনী সদর দপ্তরকে। এরপর গভীর সমুদ্রে বিভিন্ন ব্লক ভাগ করে বাংলাদেশি যুদ্ধজাহাজ স্বাধীনতার নেতৃত্বে যৌথ অভিযান চালায় ইন্দোনেশিয়ান যুদ্ধজাহাজ ইয়ুস সুদারসু, চীনের যুদ্ধজাহাজ জাহাজ ইয়াংচেনসহ নৌবাহিনীর আরও ৪টি যুদ্ধজাহাজ।
এর আগে, ২৭ নভেম্বর কক্সবাজারের ইনানী সৈকত থেকে বহুপাক্ষিক এ মহড়ার উদ্বোধন করেন রাষ্ট্রপতি মো. আবদুল হামিদ। তিনি বলেন, কারও একার পক্ষে সমুদ্র সন্ত্রাস মোকাবিলা করা সম্ভব নয়। ভারত মহাসাগরীয় এ সংগঠনকে সমুদ্র সম্পদের নিরাপত্তা নিশ্চিতে কাযকর ভূমিকার রাখার আহ্বান জানান তিনি। ‘ব্লু ইকোনোমির’ গুরুত্ব তুলে ধরে রাষ্ট্রপতি বলেন, ভারত মহাসাগরীয় অঞ্চলের রাষ্ট্রগুলোকে মেরিটাইম ব্যবসা-বাণিজ্য বাড়াতে একযোগে কাজ করতে হবে। আমরা সবাই সাম্প্রতিক সময়ে ভারত মহাসাগরীয় অঞ্চলের কৌশলগত ও অর্থনৈতিক গুরুত্ব সম্পর্কে সচেতন আছি। সাগরের সম্পদ উত্তোলন, ব্যবসা-বাণিজ্যসহ বিভিন্ন ক্ষেত্রে এই অঞ্চলের বিশাল সম্ভাবনা রয়েছে। এ সম্ভাবনার কথা মাথায় রেখে বাংলাদেশ সরকার সমুদ্র খাতের উন্নয়নের উদ্যোগ নিয়েছে।
জানা গেছে,২০০১ সালে বাংলাদেশ নৌবাহিনী প্রথম বারের মত জাটকা বিরোধী কর্মসূচি অপারেশন জাটকা অভিযান শুরু করে। বাংলাদেশ নৌবাহিনীর টহল জাহাজ প্রতিবছরই বিপুল পরিমাণ অবৈধ কারেন্ট জাল আটক ও ধ্বংস করে মৎস্য সম্পদ সংরক্ষণ ও দেশের অর্থনৈতিক উন্নয়নে বিশেষ ভূমিকা পালন করে। বিশাল সমুদ্রে অবৈধ অস্ত্র ও মালামাল বহনকারী জাহাজ ও নৌকা এবং সন্ত্রাসীদের আটক করার জন্য কুতুবদিয়া চ্যানেল ও মহেশখালীতে নৌবাহিনীর জাহাজ ও নৌসদস্যরা নির্ঘুম প্রহরীর ভূমিকা পালন করে যাচ্ছে।
বিশাল সমুদ্র সীমানা রক্ষা, নৌ পথে মানব পাচার রোধ ও অবৈধ মৎস্য আহরণ রোধ করতে প্রতিনিয়ত ৫ থেকে ৭ টি নৌবাহিনী জাহাজ টহলে রয়েছে। বিদেশ থেকে মাদক দ্রব্য ও ইয়াবা বাংলাদেশে প্রবেশ রোধ করে বাংলাদেশ নৌবাহিনী এদেশের যুব শক্তিকে ধ্বংসের হাত থেকে রক্ষা করছে। দেশের সমুদ্রে অন্যদেশের মাছ ধরার ট্রলার আটক করে ইতোমধ্যে বাংলাদেশ নৌবাহিনীর অকুতোভয় নাবিকরা নিজের জান-মাল বাজি রেখে বাংলাদেশের মৎস্য সম্পদ রক্ষায় গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা পালন করে যাচ্ছে। উপকূলীয় এলাকা সেন্টমার্টিন এর প্রবাল দ্বীপ সমূহ, কুতুবদিয়া, মহেশখালি, কক্সবাজারে বাংলাদেশ নৌবাহিনীর নিয়মিত অপারেশনের ফলে হাজার হাজার মানুষকে নিরাপত্তা প্রদান করা যাচ্ছে বলেও জানান নৌ-সদস্যরা।
খুলনায় এক অনুষ্টানে নৌ-বাহিনী প্রধান এডমিরাল নিজামউদ্দিন আহমেদ বলেন, আগামী ২০৩০ সালের মধ্যে নৌবাহিনীকে একটি আধুনিক বাহিনী হিসেবে গড়ে তোলার লক্ষ্যে ইতোমধ্যে বিভিন্ন স্বল্প এবং দীর্ঘমেয়াদী পরিকল্পনা গ্রহণ করা হয়েছে। বর্তমান সরকারের সময়ে নৌবহরে যুক্ত হয়েছে সর্বোচ্চ সংখ্যক যুদ্ধজাহাজ, মেরিটাইম পেট্রোল এয়ারক্রাফ্ট, হেলিকপ্টার ও বিশেষায়িত ফোর্স সোয়াড্স। এছাড়া, আরও দু’টি মেরিটাইম পেট্রোল এয়ারক্রাফ্ট ক্রয়ের পরিকল্পনা রয়েছে। তাছাড়া চলতি বছরে মার্চে দু’টি সাবমেরিন সংযোজনের মাধ্যমে বাংলাদেশ নৌবাহিনী এখন ত্রিমাত্রিক শক্তি হিসেবে প্রতিষ্ঠিত হয়েছে। এছাড়া, পটুয়াখালীর রাবনাবাদ এলাকায় নৌবাহিনীর একটি নৌ-ঘাঁটি, ঢাকার খিলক্ষেতে একটি পূর্ণাঙ্গ নৌ ঘাঁটি এবং চট্টগ্রামের পেকুয়ায় একটি সাবমেরিন ঘাঁটির নির্মাণ কার্যক্রম চলমান রয়েছে।