নিজস্ব প্রতিবেদক | ০৪ ডিসেম্বর ২০১৭
জাতিসংঘের শান্তিরক্ষী মিশনে বাংলাদেশের হয়ে সফল ভাবে পেশাগত দায়িত্ব শেষ করতে চায় প্রথমবারের মতো শান্তিরক্ষী মিশনে যাওয়া নারী পাইলট ফ্লাইট লেফটেনেন্ট নাইমা হক ও তামান্না ই লুৎফী। গত ৩ বছর ধরে দূর্গোম পরিবেশে বিভিন্ন প্রশিক্ষনের মাধ্যমে শান্তিরক্ষী মিশনে দায়িত্ব পালনের জন্য নিজেদের তৈরী করেছে এ দুই পাইলট। সশস্ত্র বাহিনীর ইতিহাসে প্রথমবারের মতো হেলিকপ্টার নিয়ে কঙ্গোতে শান্তিরক্ষী মিশনে পেশাগত দায়িত্ব পালনের সুযোগ পাওয়া এ দুই নারী পাইলট আগামী ৭ ডিসেম্বর কঙ্গোর উদ্দ্যেশে দেশ ত্যাগ করবে। আজ সোমবার বিমান বাহিনীর বাশার ঘাটিতে প্রথমবারের মতো মিশনে যাওয়া উপলক্ষে এ দুই নারী পাইলট সাংবাদিকদের মুখোমুখি হলে প্রতিক্রিয়া ব্যক্ত করতে গিয়ে এসব কথা বলেন।
প্রথমবারের মতো মিশনে চাওয়ার চ্যালেঞ্জ সম্পর্কে ফ্লাইট ল্যাফটেনেন্ট নাইমা হক তার প্রতিক্রিয়া ব্যক্ত করে বলেন, দেশের ইতিহাসে কোন নারী পাইলট প্রথমবারের মতো হেলিকন্টার নিয়ে কঙ্গোর মতো দেশের দূর্গোম অঞ্চলে যাওয়া দেশের জন্য বড় অর্জন। আমরা কঙ্গোতে নিজেদের দায়িত্ব পালন একটি চ্যালেঞ্জ হিসেবে নিয়েছি। যেহেতু কঙ্গোতে অনেক দূর্গোম পাহাড়ী এলাকায় আমাদের হেলিকপ্টার ফ্লাই করতে হতে এ জন্য গত ৩ বছর বিভিন্ন প্রশিক্ষনের মাধ্যমে নিজেদের যোগ্য হিসেবে তৈরী করতে হয়েছে।
বিমান বাহিনীর গর্বিত সদস্য হয়ে আমরা আমাদের প্রতিষ্ঠানের উর্ধ্বতন কর্মকর্তাদের দিক নির্দেশনা ও সহযোগিতার মাধ্যমে কিভাবে দূর্গোম অঞ্চলে ফ্লাই করতে হবে এর সব ধরনের যুগোপযোগি প্রশিক্ষণ সফল ভাবে শেষ করেছি। কঙ্গোর পাহাড়ী দূর্গোম অঞ্চলে যাতে আমাদের ফ্লাই করতে কোন অসুবিধা না হয় সে জন্য চট্টগ্রামের হিলটেক্সসহ বিভিন্ন পাহাড়ী অঞ্চলে আমারা ফ্লাই করে হেলিকপ্টার নামিয়েছি। এছাড়া যে ধরনের প্রশিক্ষন দরকার শান্তিরক্ষী মিশনে দায়িত্ব পালনের জন্য সব ধরনের প্রশিক্ষন আবার শেষ করেছি।
ফ্লাইট লেপটেনেন্ট নাইমা হক বলেন, কঙ্গোর যেকোন বৈরী পরিবেশে নিজেদের মানিয়ে নিয়ে পেশাগত দায়িত্ব সফলভাবে শেষ করার জন্য আমরা পরিপূর্ণভাবে প্রস্তুত রয়েছি। আগামী ১ বছর আমরা সফলভাবে মিশনে নিজেদের উপর অর্পিত দায়িত্ব শক্তভাবে শেষ করার মাধ্যমে বাংলাদেশ বিমান বাহিনী তথ্য দেশের সুনাম অক্ষুন্ন রাখতে চাই। এ মিশন যাতে অন্য নারী পাইলটের জন্য অনুকরনী হয়ে থাকে সে জন্য মিশন সফল মিশন শেষ করে পরিবারের কাছে সুস্থভাবে ফিরে আসতে চাই।
ফ্লাইট লেফটেনেন্ট তামান্না ই লুৎফী তার প্রতিক্রিয়া ব্যক্ত করতে গিয়ে বলেন, জাতিসংঘের শান্তিরক্ষী এ মিশনে বিমান বাহিনীর ৩শর বেশি সদস্যের মধ্যে ১৫ জন নারী সদস্য রয়েছে। এর মধ্যে পাইলট হিসেবে আমরা দুজন শান্তিরক্ষী মিশনে টিমকে সব ধরনের সহযোগিতা করবো। তামান্না ই লুৎফী আরো বলেন, বাংলাদেশ বিমান বাহিনী একটি ডায়নামিক ফোর্স হিসেবে পরিচিত। এখানে মেয়েদের জন্য কাজ করার পরিবেশ অত্যন্ত চমৎকার। আমি বাংলাদেশের নারীদের জন্য বললো আপনাদের যদি কারো ইচ্ছে থাকে তাহলে সে ইচ্ছেকে শক্তিতে পরিনত করে বিমান বাহিনীতে যোগ দেওয়া এবং যেকোন চ্যালেঞ্জ মোকাবেলায় নিজেদের তৈরী করতে হবে। শুধু ইচ্ছে থাকলেই হবে না ইচ্ছে পূরণ করতে হবে পরিশ্রম মেধা এবং চ্যালেঞ্জ মোকাবেলার জন্য সাহস রাখতে হবে। পাইলট তামান্না বলেন, আমাদের পূর্বসুরিরা যে কাজ করেছে তারই ধারাবাহিকতা আমরাও বজায় রাখতে চাই। আমরা চেষ্টা করতো নিজেসের সবচ্চো মেধা দিয়ে শান্তিরক্ষী মিশনে কাজ করে দেশের জন্য সুনাম বয়ে আনতে।
বাংলাদেশ বিমান বাহিনীর দুইজন নারী বৈমানিক ফ্লাইট লেফটেন্যান্ট নাইমা হক ও ফ্লাইট লেফটেন্যান্ট তামান্না-ই-লুৎফী প্রথমবারের মত জাতিসংঘ শান্তিরক্ষা মিশনে যোগদানের মাধ্যমে বাংলাদেশের সামরিক ইতিহাসে এক নতুন মাইল ফলক স্থাপন করেছে। তারা জাতিসংঘ মিশন কঙ্গোতে যোগদানের উদ্দেশ্যে আগামী ৭ ডিসেম্বর ঢাকা ত্যাগ করবে। তারা কঙ্গো শান্তি মিশনে এক বছরের জন্য নিয়োগ পেয়েছেন । ঢাকা ত্যাগের পূর্বে জাতিসংঘ মিশনে যোগদানের উপর তাদের মতামত আজ সোমবার (০৪-১২-২০১৭) ঢাকা সেনানিবাসস্থ ঘাঁটি বাশারে সাংবাদিকদের নিকট উপস্থাপন করেন।
বিমান বাহিনী সূত্র জানায়, যোগ্যতা ও মেধা সম্পন্ন যে কেউ সামরিক বাহিনীর মতো চ্যালেঞ্জিং পেশায় আসতে পারেন এবং এখানে মেধা বিকাশের পর্যাপ্ত সুযোগ সুবিধা রয়েছে। বাংলাদেশের অর্ধেক জনগোষ্ঠী নারী বিধায় সর্বক্ষেত্রে নারীর সম-অংশগ্রহণই নিশ্চিত করতে পারে দেশের সার্বিক আর্থ-সামাজিক উন্নয়ন। এই প্রেক্ষাপটে বাংলাদেশ বিমান বাহিনী ২০০০ সালে সর্বপ্রথম সামরিক বাহিনীতে নারী কর্মকর্তা নিয়োগ শুরু করে। সময়ের পরিক্রমায় বিমান বাহিনীর বিভিন্ন শাখার নারী কর্মকর্তারা বিমান বাহিনী ছাড়াও জাতিসংঘ সহ বিভিন্ন আন্তর্জাতিক অঙ্গণে পেশাদারিত্ব ও দায়িত্ববোধের পরিচয় দিয়েছেন। আর এরই ধারাবাহিকতায় বাংলাদেশ বিমান বাহিনী প্রথমবারের মত ২জন নারী বৈমানিককে জাতিসংঘ শান্তিরক্ষা মিশনে নিয়োগ দিয়েছে ।
সামরিক বৈমানিক এর মত চ্যালেঞ্জিং ও ঝুকিপূর্ণ পেশায় নারী বৈমানিকদের গড়ে তোলার লক্ষ্যে প্রয়োজনীয় যাচাই বাছাই-এর পর বিমান বাহিনীতে কর্মরত দুইজন নারী কর্মকর্তা ফ্লাইট লেফটেন্যান্ট নাইমা হক এবং ফ্লাইট লেফটেন্যান্ট তামান্না-ই-লুৎফি মনোনিত হন উড্ডয়ন প্রশিক্ষণে প্রশিক্ষণার্থী হিসেবে। বাংলাদেশ বিমান বাহিনী ঘাটি বীরশ্রেষ্ঠ মতিউর রহমানের ১৮ নং স্কোয়াড্রনে বেল-২০৬ হেলিকপ্টারে বেসিক কনভার্সন কোর্সের জন্য মনোনিত হওয়া এই দুই নারী কর্মকর্তা ২০১৪ সালের ৩ আগস্ট থেকে তাদের গ্রাউন্ড প্রশিক্ষণ শুরু করেন। ২০১৪ সালের ২৩ সেপ্টেম্বর প্রথমবারের মত তাদের উড্ডয়ন প্রশিক্ষণ শুরু করেন। পরবর্তীতে ২৫ ঘন্টা সফল প্রশিক্ষণ উডডয়ন শেষে তারা একক উড্ডয়ন তথা প্রথম একক উড্ডয়ন (সোলো ফ্লাইট) সম্পন্ন করেন। এভাবে দুই নারী কর্মকর্তা ২০১৪ সালের ১৭ ডিসেম্বর তাদের প্রশিক্ষণের একটি গুরুত্বপূর্ন ধাপ অতিক্রম করে বৈমানিক হয়ে ওঠার প্রাথমিক পর্যায় শেষ করেন।
বিমান বাহিনী সূত্র জানায়, প্রশিক্ষণরত এই বৈমানিকদ্বয় বেল-২০৬ হেলিকপ্টারে ৬৫ ঘন্টা উড্ডয়নের প্রাথমিক ধাপ সম্পন্ন করার পর পরবর্তীতে বিমান বাহিনীর বিভিন্ন হেলিকপ্টার স্কোয়াড্রনে দায়িত্ব পালন করেন। তারা ২০৬ হেলিকপ্টার কনভারশন কোর্স, এমআই-১৭, এমআই-১৭১ এবং এমআই-১৭১ এসএইচ হেলিকপ্টার প্রশিক্ষণ সমাপ্ত করেছেন। তারা ভারত থেকে এভিয়েশন মেডিসিন-এ প্রশিক্ষণ গ্রহণ করেন। তারা দুজনই পার্বত্য চট্টগ্রামে অপারেশন্স উত্তরনে অপারেশনাল পাইলট হিসেবে দায়িত্ব করেছেন। পেশাগত জীবনে বৈমানিক হিসেবে তাদের এই সাফল্য বিমান বাহিনী এবং বাংলাদেশের সশস্ত্র বাহিনীর উড্ডয়নের ক্ষেত্রে একটি মাইলফলক হিসেবে বিবেচিত হবে। বিমান বাহিনীর এই যুগান্তকারী পদক্ষেপ, নারীর ক্ষমতায়নে বাংলাদেশ সরকারের অঙ্গীকার বাস্তবায়ন ও বাংলাদেশের মেয়েদের অগ্রযাত্রায় এক নতুন দিগন্তের সূচনা করবে । দেশের গন্ডি পেরিয়ে জাতিসংঘ শান্তিরক্ষা মিশনে তাদের যোগদান বাংলাদেশের সামরিক ইতিহাসে এক গৌরব উজ্জল অধ্যায়ের সূচনা করেছে।
আন্তবাহিনী জনসংযোগ পরিদপ্তর থেকে জানানো হয়, ব্যক্তিগত জীবনে ফ্লাইট লেপটেনেন্ট নাইমা হক ১৯৯০ সালের ২০ এপ্রিল ব্রাক্ষনবাড়িয়ার শাহবাজপুর থানার মোহাম্মদ নাজমুল হক ও নাসরিন বেগম দম্পতি ঘরে জম্মগ্রহন করে। ঢাকার হলিক্রস গার্লস স্কুল থেকে এসএসসি এবং হলিক্রস কলেজ থেকে এইচ এসসি পাসের পর বাংলাদেশ ইউনিভারসিটি অব প্রফোশনাল থেকে এরোমিটিকাল ইঞ্জিনিয়ারিং (বিএসসি) পাস করেন। এ পর্যন্ত সে ৪শ ঘন্টা ফ্লাই করেছে। এর পূর্বে প্রধানন্ত্রীর দপ্তরে স্পেশাল সিকিউরিটি ফোর্স এসএস এফে সফলভাবে পেশাগত দায়িত্ব পালন করেছে। বিমানবাহিনীতে যোগ দেওয়ার পর ইলেমেন্টারী এ্যডমিন কোর্স, ডাইনিটারী প্রটেক্ট কোর্স, ফ্লাই সেফটি অফিসার কোর্স এভং এভিয়েশন মেডিকেল কোর্স সহ একাধিক কোর্সে সফলভাবে প্রশিক্ষন নিয়েছে। বিভিন্ন পদে সে বিমানবাহিনীতে কর্মরত ছিলো।
ফ্লাইট লেফটেনেন্ট তামান্না ই লুৎফী বিএএফ শাহিন স্কুল এন্ড কলেজ থেকে এসএসসি ও এইচএসসি পাসের পর বাংলাদেশ ইউনিভার্সসিটি অব প্রফেশনাল থেকে বিএসসি(এরো ) পাস করেন। সে যশোরের বেনাপোলের এয়ার ফোর্সের সাবেক ইঞ্জিনিয়ারিং অফিসার গ্রুপ ক্যাপ্টেন (অবঃ) লুৎফর রহমান ও আয়শা সিদ্দিকা দম্পতির সন্তান। তামান্না ই লুৎফী বিমান বাহিনীতে যোগ দেওয়ার পর একাধিক প্রশিক্ষন নিয়েছে। পাইলট হিসেবে তামান্নাও ৪শ ঘন্টা উ্ড্ডয়ন করেছে। তামান্নার জম্ম ১৯৯৩ সালের ৫ জুলাই।