নিজস্ব প্রতিবেদক | ৩১ ডিসেম্বর ২০১৭
মূল্যায়নের কড়াকড়িতে এসএসসি ও এইচএসসির ফলাফলে ধসের পর এবার জেএসসি-জেডিসির ফলেও ধাক্কা লেগেছে, পাশাপাশি কমেছে প্রার্থমিক সমাপনীর পাসের হার। পঞ্চমের সমাপনীতে গণিত, ইংরেজি ও আরবিতে গতবারের চেয়ে খারাপ ফল হয়েছে। আর অষ্টমের সমাপনীতে ছন্দপতন ঘটিয়েছে ইংরেজি, গণিত ও বিজ্ঞানের ফল। শনিবার প্রাথমিক ও ইবতেদায়ী সমাপনী এবং জুনিয়র স্কুল সার্টিফিকেট (জেএসসি) ও জুনিয়র দাখিল সার্টিফিকেট (জেডিসি) পরীক্ষার ফল বিশ্লেষণ করে এমন ধারণাই পাওয়া গেছে।
প্রাথমিক সমাপনীতে এবার ৯৫ দশমিক ১৮ শতাংশ ও ইবতেদায়ীতে ৯২ দশমিক ৯৪ শতাংশ শিক্ষার্থী পাস করেছে। গত বছর প্রাথমিকে ৯৮ দশমিক ৫১ শতাংশ ও ইবতেদায়ীতে ৯৫ দশমিক ৮৫ শতাংশ শিক্ষার্থী পাস করেছিল। সেই হিসেবে প্রাথমিকে ৩ দশমিক ৩৩ শতাংশ পয়েন্টে এবং ইবতেদায়ীতে ২ দশমিক ৯১ শতাংশ পয়েন্ট কমেছে পাসের হার। প্রাথমিক ও ইবেতেদায়ী সমাপনী মিলিয়ে এবার ২ লাখ ৬৭ হাজার ৬৩২ জন জিপিএ-৫ পেলেও গত বছর পূর্ণাঙ্গ জিপিএ পেয়েছিল ২ লাখ ৮৭ হাজার ৮৪৬ জন। জেএসসি-জেডিসিতে এবার পাসের হার ৮৩ দশমিক ৬৫ শতাংশ, যা গতবছর ৯৩ দশমিক ০৩ শতাংশ ছিল।
জিপিএ-৫ পাওয়া শিক্ষার্থীর সংখ্যা গতবারের দুই লাখ ৪৭ হাজার ৫৫৮ জন থেকে কমে এবার হয়েছে এক লাখ ৯১ হাজার ৬২৮ জন। এই হিসেবে অষ্টমের সমাপনীতে পাসের হার এবার ৯ দশমিক ৪১ শতাংশ পয়েন্ট কমেছে, জিপিএ-৫ পাওয়া শিক্ষার্থীর সংখ্যা কমেছে ৫৫ হাজার ৯৬০ জন। পাসের হার ও জিপিএ-৫ এর সঙ্গে অন্য সব সূচকেই পঞ্চম ও অষ্টমের এবারের ফল গতবারের চেয়ে খারাপ হয়েছে।
সকালে জেএসসি-জেডিসির ফলাফলের অনুলিপি হাতে পাওয়ার পর শিক্ষামন্ত্রী নুরুল ইসলাম নাহিদ ও মন্ত্রণালয়ের কর্মকর্তাদের উদ্দেশে প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা বলেন, এ বছর যেহেতু আপনাদের নজরদারি বেড়েছে; সে কারণে হয়ত (পাসের হার) একটু কম। আশাকরি ভবিষ্যতে যেন বাড়ে। আর শিক্ষামন্ত্রী নাহিদ এবং প্রাথমিক ও গণশিক্ষা মন্ত্রী মোস্তাফিজুর রহমান রহমান ফিজার সাংবাদিকদের প্রশ্নে বলছেন, পাসের হারসহ অন্যান্য সূচকে খারাপ ফলাফলের কারণ তদন্ত করে বের করা হবে।
পাসের হার বাড়াতে ঢালাও নম্বর দেওয়া হচ্ছে- এমন অভিযোগের প্রেক্ষাপটে চলতি বছর এসএসসি ও এইচএসসির উত্তরপত্র মূল্যায়নে কড়াকড়ি বাড়ানো হয়। ফলে ওই দুই পরীক্ষাতেই পাসের হার বেশ খানিকটা কমে আসে। জেএসসি-জেডিসির ফলাফল নিয়ে সাংবাদিকদের প্রশ্নে শিক্ষামন্ত্রী নাহিদ বলেন, উত্তরপত্র মূল্যায়নের পদ্ধতি নিয়ে বাংলাদেশ এডুকেশন ডেভেলপমেন্ট ইউনিটের সুপারিশ গত তিন বছর ধরেই একটু একটু করে অনুসরণ করা হচ্ছে। ফলাফলে তার প্রভাব ‘কিছুটা’ পড়েছে।
সব সূচকে খারাপ ফল কেন- এ প্রশ্নে তিনি বলেন, “আমি এখন কোনো মূল্যায়নে যাচ্ছি না, বোর্ডগুলো নিজস্বভাবে মূল্যায়ন করবে, মন্ত্রণালয় তদারকি করবে বা আলাদা তদন্ত করবে। তখন সঠিক চিত্রটা জানা যাবে। আন্তঃশিক্ষা বোর্ড সমন্বয় সাব-কমিটির পরীক্ষা নিয়ন্ত্রক তপন কুমার সরকার বলেন, ইংরেজি, গণিত ও বিজ্ঞানে পাসের হার কমে যাওয়ার সার্বিক ফলাফলে এর প্রভাব পড়েছে। ফল বিশ্লেষণ করে দেখা যায়, জেএসসিতে এবার আট বোর্ডেই ইংরেজি, গণিত ও বিজ্ঞানে পাসের হার ব্যাপক হারে কমেছে। অন্যান্য বিষয়েও পাসের হার কিছুটা কম হওয়ায় সার্বিক পাসের হার কমেছে। আর কুমিল্লা বোর্ডের বড় ধাক্কা সার্বিকভাবে টেনে ধরেছে পুরো দেশের পাসের হার।
অষ্টমের সমাপনী: কোন বিষয়ের কেমন ফল
বোর্ড |
ইংরেজি |
গণিত |
বিজ্ঞান |
|||
|
২০১৬ |
২০১৭ |
২০১৬ |
২০১৭ |
২০১৬ |
২০১৭ |
ঢাকা |
৯৪.১৪ |
৮৮.২৫ |
৯৭.৩২ |
৯১.৩৯ |
৯৮.৯৩ |
৯৮.২৮ |
রাজশাহী |
৯৮.১৭ |
৯৭.০৩ |
৯৯.৪৯ |
৯৮.৪০ |
৯৯.৯৪ |
৯৯.৮৭ |
কুমিল্লা |
৯২.০৮ |
৭০.৭০ |
৯৭.০৫ |
৮২.৪৬ |
৯৯.৩৬ |
৯১.১৮ |
যশোর |
৯৬.৪২ |
৯০.৬৬ |
৯৮.৫৮ |
৮৮.৩৩ |
৯৯.৫৮ |
৯৫.১৫ |
চট্টগ্রাম |
৯৪.০২ |
৯২.০৬ |
৯৬.০৫ |
৯১.৫১ |
৯৯.০৮ |
৯৫.১৫ |
বরিশাল |
৯৯.১৭ |
৯৬.৮৬ |
৯৯.১৭ |
৯৭.২১ |
৯৯.৮৬ |
৯৮.৯৬ |
সিলেট |
৯৬.৬২ |
৯৬.০১ |
৯৮.৪২ |
৯৩.৮১ |
৯৯.২৪ |
৯৮.২৩ |
দিনাজপুর |
৯৫.৩৩ |
৯৪.২৩ |
৯৭.১৮ |
৯৩.৫৯ |
৯৯.৬৩ |
৯৬.৮৭ |
প্রাথমিক সমাপনীতেও ইংরেজি ও গণিতে গতবারের তুলনায় খারাপ করেছে ক্ষুদে শিক্ষার্থীরা; ইবতেদায়ীতে তার সঙ্গে যুক্ত হয়েছে আরবি। সার্বিক ফলফলে পাসের হার কমেছে। ফল খারাপ হল কেন- এই প্রশ্নে প্রাথমিক ও গণশিক্ষা মন্ত্রী ফিজার বলেন, মানুষের প্রত্যাশা তো সব সময় পূরণ হয় না, তবে আমরা চেষ্টা করতেছি। এখনও তো শতভাগে আমরা যাইনি। ভালোর কোনো শেষ নেই, শেষ ধাপ পর্যন্ত যাওয়ার আমরা চেষ্টা করে যাব। প্রাথমিকে কেন পাসের হার ও জিপিএ-৫ পাওয়া শিক্ষার্থীর সংখ্যা কমেছে- তা জানতে গবেষণা করতে হবে বলে মন্তব্য করেন তিনি।
পঞ্চমের সমাপনী: বিষয়ভিত্তিক চিত্র
প্রাথমিক |
ইংরেজি |
গণিত |
বাংলাদেশ ও বিশ্ব পরিচয় |
প্রাথমিক বিজ্ঞান |
ধর্ম ও নৈতিক শিক্ষা |
২০১৬ |
৯৯.২৭ |
৯৯.৩৩ |
৯৯.৭৯ |
৯৯.৭৯ |
৯৯.৯২ |
২০১৭ |
৯৭.৫০ |
৯৮.২১ |
৯৯.২৩ |
৯৯.৪৮ |
৯৯.৭৪ |
ইবতেয়ী |
ইংরেজি |
গণিত |
আকাইদ ও ফিকহ |
আরবি |
সমাজ-বিজ্ঞান |
২০১৬ |
৯৮.২২ |
৯৮.৭৭ |
৯৯.৭৬ |
৯৮.৯৮ |
৯৯.২৫ |
২০১৭ |
৯৬.৯১ |
৯৮.১৫ |
৯৯.৩৩ |
৯৭.৮৪ |
৯৮.৫০ |
অপ্রয়োজনীয় পরীক্ষা?
পাবলিক পরীক্ষাগুলোতে গত কয়েক বছর ধরে প্রশ্নফাঁসের ধারায় এবার পঞ্চম ও অষ্টমের সমাপনীতেও প্রায় সব পরীক্ষায় প্রশ্ন ফাঁস হয়েছে, যা নিয়ে সমালোচিত হয়েছে সরকার। ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের অধ্যাপক সৈয়দ মনজুরুল ইসলামের মতে, বর্তমানের মুখস্তনির্ভর পরীক্ষা পদ্ধতিতে জিপিএ-৫ পাওয়ার অসুস্থ প্রতিযোগিতা প্রশ্ন ফাঁসের বিষয়টিকে আরও গুরুতর আকার দিয়েছে। পঞ্চম ও অষ্টম শ্রেণিতে এ দুটো সমাপনী পরীক্ষার কোনো প্রয়োজন তিনি দেখছেন না।
তিনি বলেন, এগুলোর কোনো প্রয়োজন নেই। এই পাবলিক পরীক্ষা দিয়ে বাচ্চাদের উপর এত চাপ সৃষ্টি করা হয়… এটা অসুস্থ প্রতিযোগিতা। এ বয়সে বাচ্চারা আনন্দ নিয়ে পড়াশোনা করবে, পরীক্ষা হবে শ্রেণিভিত্তিক। প্রধানমন্ত্রী বলে আসছেন, সমাপনী পরীক্ষার কারণে বাচ্চাদের মধ্যে পরীক্ষা ভীতি আর থাকছে না, তাদের সাহস ও আত্মবিশ্বাস বাড়ছে। এ বিষয়ে দৃষ্টি আকর্ষণ করলে অধ্যাপক মনজুরুল বলেন, আত্মবিশ্বাস হয়ত বাড়ে, সে জায়গায় আপত্তি করছি না। তবে কীসের মূল্যে আত্মবিশ্বাস পাচ্ছে ওরা? প্রশ্নপত্র যদি ফাঁস হতেই থাকে আর মুখস্ত করেই যদি পরীক্ষা দেয়, এই আত্মবিশ্বাস তাদের কোথায় নিয়ে যাবে?”
মাধ্যমিকের পাঠ্যক্রম পর্যালোচনা ও বই পরিমার্জনে সরকারের গঠিত কমিটির এই সদস্য তার পর্যবেক্ষণ থেকে বলেন, এখনকার শিশুরা ক্লাসের বই ছাড়া অন্য কোনো বই পড়ছে না। তারা নিজের মত করে লিখতে পারছি কি না- সেটাই তাদের আত্মবিশ্বাসের জায়গা হওয়া উচিত। কিন্তু সেটা হচ্ছে না। আমরা তো পরীক্ষানির্ভর আর সনদমুখী ছেলেমেয়ে তৈরি করতে পারি না। …সমস্ত বছর তারা পরীক্ষার তালে থাকে। পরীক্ষা দিতে গিয়ে নকল, কোচিং সেন্টার, কোচিং বাণিজ্য গ্রাম পর্যায়েও চলে গেছে। কোচিংয়ের ভেতর দিয়ে গিয়ে একটা সনদ নিয়ে এই আত্মবিশ্বাস কত দিন থাকতে পারে?”
স্কুল কলেজ পাস করে যারা বিশ্ববিদ্যালয়ে ভর্তি হতে আসছে, তাদের ইংরেজি ও বিজ্ঞানের জ্ঞান এখন ‘অনেক দুর্বল’ বলে মনে করেন অধ্যাপক মনজুরুল। আমি মনে করি পাবলিক পরীক্ষা একটাই হওয়া উচিত, সেটা এইচএসসি। আমরা না হয় দশম শ্রেণিতেও (এসএসসি) আরেকটা পরীক্ষা নিতে পারি। পঞ্চম ও অষ্টমের সমাপনী পরীক্ষা বন্ধ করে দিয়ে শ্রেণিভিত্তিক মূল্যায়নের ব্যবস্থা করার পাশাপাশি বেতনভাতা বাড়িয়ে ভালো শিক্ষক নিয়োগে সরকারকে মনোযোগ দেওয়ার পরামর্শ দেন তিনি। শিক্ষা ব্যবস্থা এভাবে চলতে থাকলে আমি জাতির সম্পূর্ণ ধ্বংস দেখতে পাচ্ছি। আমরা মারাত্মক পথে চলছি। আমরা মেধাহীন জাতি তৈরি করছি।